সরকারি তোলারাম কলেজের ইতিবৃত্ত
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জ বৌদ্ধ-হিন্দু-পাঠান-মোঘলের পদস্পর্শে নগর সভ্যতাই পদার্পণ করেছে। ইংরেজ কর্মচারি ‘ ভিখন লাল ঠাকুর’ মনিবদের প্রতি অগাধ বিশ্বাসের উপঢৌকন হিসেবে এই এলাকার কিছু অংশের ভোগসত্ব লাভ করেছিলেন। ধর্মপরায়ন এই মনীষী লক্ষ্মী নারায়ণয়ের আখরা নামের মন্দিরে নারায়াণ বিগ্রহ প্রতিস্থাপন করেছিলেন। এই আখড়া ও মন্দিরকেঘিরে একটি ‘গঞ্জ’ তৈরি হয়েছিল।
কালের বিবর্তনে গঞ্জের প্রভাবে একসময় জায়গাটির নামকরণ হয় ‘নারায়ণগঞ্জ’। পাট এবং পৃথিবী বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের বদৌলতে বিদেশিদের আনাগোনায় নারায়ণগঞ্জ দিনরাত কর্মচঞ্চল থাকত। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জ শহর প্রথম থেকেই ধন-সম্পদে পূর্ণ ছিল। সম্পদের মোহে এই শহরের সবাই যখন ব্যবসা-বাণিজ্যে মশগুল, তখন একান্ত-মনে বিদ্যার আলো বিস্তারের চিন্তায় ব্যস্ত বাবু খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।
ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা অঞ্চলের মানুষ, দর্শনে উচ্চশিক্ষিত অসাম্প্রদায়িক খগেন্দ্র বাবু দৃঢ়মনে পরিকল্পনা করেন ঐশ্বর্যময় নারায়ণগঞ্জে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার। মনে তাঁর অসীম সাহস, হৃদয়ে আকাশের অসীমতা, দৃষ্টিতে অনাগত সময় দেখার অকল্পনীয় ক্ষমতা। কিন্ত পকেট শূন্য। বাস্তবে অর্থহীন চিন্তা অর্থহীন। তবে তিনি দমবার পাত্র নন। প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রত্যয়ে ধনী ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে তাঁর পদচারণা। তৎকালিন নারায়ণগঞ্জবাসীর বিত্ত থাকলেও উদার চিত্ত ছিল না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য অর্থ ব্যয় করার মানসিকতা ছিল না। ফলে খগেন্দ্র বাবু স্মরণাপ্নন হন বৃহত্তর ময়মনসিংহের বর্তমান টাংগাইল জেলার মির্জাপুরের দানবীর ‘রনদা প্রসাদ সাহার’। ঊদ্দমী পুরুষের বিদ্যা-সম্পর্কিত মহাপরিকল্পনার কথা শুনে দাতা রণদা প্রসাদ তাঁকে পঁচিশ হাজার টাকা দান করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জের পাট ব্যবসায়ী তোলারাম বসরাজের ছেলে ‘মদন লাল সারোগী’ ও কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য পঁচিশ হাজার টাকা দান করেন। এই টাকাগুলো পেয়েই দার্শনিক খগেন্দ্র বাবু আরও বেশি উদ্দমী হয়ে গড়ে তোলেন ‘নারায়াণগঞ্জ উইমেন্স কলেজ’। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে মাত্র পাঁচ ছাত্রী নিয়ে আরম্ভ হওয়া কলেজটি যখন একটু একটু করে প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধের ছোবলে বিবর্ণ হয়ে গার্লস কলেজটি বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্য ঘটে খগেন্দ্র বাবুর গড়া প্রতিষ্ঠানটির।
ধরার ঘূর্ণয়মান কালচক্রে মানবসৃষ্ট প্রতিষ্ঠান হারিয়ে যেতে পারে। কিন্ত স্রষ্টার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের স্বপ্ন হারায় না, কল্পনা ধূলিসাৎ হয় না। খগেন্দ্র বাবুর স্বপ্নও মরা যায় নি। যুদ্ধোত্তর কালে দৃঢ়চেতা এই কর্মী পুরুষ আবার মনোযোগী হন কলেজ চালু করতে। এবার পাশে পান মহান হৃদয়ের অধিকারী, শিখানুরাগী ও দাতা পাট ব্যবসায়ী ‘তোলারাম বসরাজ’কে। তিনি কলেজ নির্মাণ করার জন্য নগদ এক লক্ষ টাকা দান করেন । দাতার নামানুসারে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলের পরিত্যক্ত ব্যায়ামাগারে শুরু হয় ‘তোলারাম কলেজ’। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘আল্লামা ইকবাল রোডে’ জমি ক্রয় করে এক তলা ভবন নির্মাণের পর ক্লাস শুরু হয়। ভবনটি উদ্বোধন করেন পুর্ববঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ‘আবু হোসেন সরকার’। কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রিন্সিপাল ছিলেন জ্ঞানপিপাসু, স্বপ্নদ্রষ্টা, পরোপকারী বাবু খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তাঁর জ্বালানো বিদ্যার ক্ষুদ্র আলো থেকে অসংখ্য আলো। এই আলোর শিখা বর্ধিত হতে হতে পুরো নারায়ণগঞ্জ আলোকিত হয়ে ক্রমান্বয়ে সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। সুনামে ‘তোলারাম কলেজ’ পরিচিতি পায় সবার কাছে। বর্তমান কলেজের মূল বহুতল ভবনটি তৈরি হয় ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে। দানবীর আর পি সাহার দেড় লাখ টাকার অনুদানে তৈরি হয় তোলারাম কলেজের বিজ্ঞান গবেষণাগার এবং ক্রয় করা হয় প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।
সুনামের কারণে ঐতিহ্যবাহী তোলারাম কলেজ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার বাইরে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে । ষাটের দশক থেকেই চাকুরীজীবি ও কর্মজিবি শিক্ষার্থীদের জন্য তোলারাম কলেজ এ নৈশ বিভাগ চালু ছিল। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে নৈশ বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম থেকেই এই কলেজের শিক্ষার্ পরিবেশ ছিল ভালো। শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফলও ছিল সন্তোষজনক এবং ঈর্ষণীয়। এই কলেজের ছাত্র মো. সাজ্জাদ হোসেন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে বি. কম. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে কলেজটির সম্মান বৃদ্ধি করেছিল। সে বৎসর তোলারাম কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শ্রেষ্ঠস্থান অধিকার করেছিল।
আজ থেকে কয়েক দশক আগে সেই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়নি, আধুনিকতা পরিপূর্ণভাবে বিকাশ লাভ করেনি, তখন ‘তোলারাম কলেজের’ শিক্ষার্থীরা পাক-ভারত সফর করেছে। জ্ঞানার্জনের অত্যুগ্র বাসনা নিয়েই শিক্ষার্থীরা কলকাতা, দিল্লী, আগ্রা, বিহার, পিণ্ডি, পেশোয়ার ও করাচী পরিভ্রমণ করে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করেছে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও এই কলেজের রয়েছে গৌরবময় ঐতিহ্য। সেই ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে কলেজের শিক্ষার্থীরা ‘ডায়মন্ড সিনেমা হলে’ মঞ্চস্থ করেছিল ‘শাহজাহান’ এবং ‘মহুয়া’ নাটক। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ‘ছাত্রসংসদ’ দেয়ালিকা এবং বার্ষিক ম্যাগাজিন প্রকাশ করে সুনাম অর্জন করেছিল। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই কলেজে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সর্বজনের হৃদয় হরণকারী বিজ্ঞান মেলাটির সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন তোলারাম কলেজের তৎকালীন তুখোড় ছাত্রনেতা ও বিজ্ঞান পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জনাব সামসুল ইসলাম ভূঁইয়া। তোলারাম কলেজের শিক্ষার্থীরা পরিবেশগত কারণেই রাজনীতি সচেতন। তারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভূ̈ত্থান, ১৯৭১ সালের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ হন তোলারাম কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র আব্দুল আওয়াল।
১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ এই কলেজটিকে জাতীয়করণ করা হয়। সরকারি কলেজের মুকুট পরিধান করে কলেজের সুনাম, কলেবর এবং কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তোলারাম কলেজের প্রাক্তন ছাত্র এবং সাবেক সংসদ সদস্য জনাব এ. কে. এম শামীম ওসমানের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় ১৯৯৬-৯৭ সেশনে সরকারি তোলারাম কলেজে ১২টি বিষয়ে অনার্স এবং ০৫টি বিষয়ে এম.এ কোর্স খোলা হয়। তাঁর ঘোষণায় কলেজের কলা ভবনের নামকরণ করা হয় ”শহিদ জননী জাহানারা ইমাম ভবন”। বর্তমানে কলেজটিতে এইচ এস সি, বি এ (পাস), ১৪টি বিষয়ে অনার্স, ০৫টি বিষয়ে এম,এ প্রথমপর্ব এবং ১৪টি বিষয়ে এম, এ শেষপর্ব চালু রয়েছে। বর্তমানে ‘সরকারি তোলারাম কলেজ’- এ অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রায় ১৮০০০ জন।
‘সরকারি তোলারাম কলেজের’ সহশিক্ষা কার্যক্রমও উন্নত। নিয়মিতভাবে এই কলেজে ইনডোর গেইম, আউটডোর গেইম, বার্ষিক মিলাদ, বার্ষিক বনভোজন এবং শিক্ষা সফর অনুষ্ঠিত হয়। কলেজের রোভার স্কাউট, বিএনসিসি এবং গার্লসিং রোভাররা বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে। এই কলেজে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর মধ্যে রয়েছে মধুর সম্পর্ক। এর ফলে কলেজের ফলাফল অত্যন্ত সন্তোষজনক। ভাল ফলাফলের কারণে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারি তোলারাম কলেজ জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ কলেজরূপে পুরস্কৃত হয়।
সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে শিক্ষালাভ করে অনেকে জাতীয় পর্যায়ে সফল ও স্বনামধন্য হয়েছেন। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে এই কলেজ এবং নারায়ণগঞ্জের সুনাম বৃদ্ধি করেছেন।